আশ্বিনে রান্ধে কার্তিকে খায়
যে বর মাঙ্গে সেই বর পায়"
আশ্বিন ফুরিয়ে গেল। যেরকম প্রতি বছরই ফুরিয়ে যায়। আবার পরের বছর আসে। আসলে আশ্বিন ফুরিয়ে গেলে ধীরে ধীরে ঠান্ডা পড়ে, ঘাসের উপর শিশির পড়ে। বিন্দু বিন্দু জলকণা জমা হয়।?মাথায় ওশ পড়ে। আশ্বিনে শিউলি ফোটে। আরও কত কীইই।
আশ্বিনের শেষ দিন মানে সংক্রান্তির দিন গাস্যি উজ্জাপণ হয় বাংলার মেয়ে বউদের ঘরে ঘরে। গাস্যি বা গারসি আবার কোনো কোনো জায়গায় বলা হয় গাড়ু। এই সংক্রান্তির পূর্বদিনে কাক নিমন্ত্রণ করবার রীতিটিও বেশ প্রাচীন। কাক নিমন্ত্রণ -- শুনে অবাক লাগছে বৈকি। কাককে ধরা হয় পূর্বপুরুষ। ঠিক যেভাবে মহালয়ার দিন তর্পণ করে বাড়ির পুরুষ মানুষটি তার পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য নিয়ে জল দান করেন এই কাক খাওয়ানোও অনেকটা একই রকম।
"আয় আয় কা-কা
আমাগো বাড়ি খাইয়া যা"
এই হল এই নিমন্ত্রণটির মূল মন্ত্র।
এতো গেল আগের দিনের কথা। পরের দিন সকালে উঠে স্নান করে পরিস্কার বস্ত্র পরে বাড়ির প্রধান তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে এই গারসি ব্রতর শুভ সূচনা হয়। ঘরে দুয়ারে আলপনা দিয়ে ধান দিয়ে তৈরি ছড়া দিয়ে সাজিয়ে ঘরের সব দরজার মাথায় লাগিয়ে তবে এই ব্রত শুরু হয়। কথিত আছে এই ব্রত করলে সন্তান সন্ততি নিয়ে সুখে জীবন যাপন করা যায়। ঘরে কোনো সময় লক্ষ্মীর অভাব হয় না।
এই ব্রত উজ্জাপণ করতে প্রধান দরকার হয় পরিশুদ্ধ বস্ত্রে কাওন চালের ভাত রান্না। সেই ভাত পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘি, সৈন্ধব লবণ এবং নারকেলকোড়া দিয়ে মেখে দলা পাকিয়ে ছাদে হোক বা বাড়ির কোনো কোণে ধোয়া কলাপাতার ওপর রেখে সাথে একটি গ্লাসে জল দিয়ে ভক্তি ভরে কাক অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে রেখে আসতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় কাক খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে সেই ভাত। এই ভাত খেলে নাকি বাস্তবে কাকের শরীর মসৃণ হয়। এসব প্রথার সাথে কতটা বাস্তবের যোগ আছে আমরা জানি না তবু চিরাচরিত ভূষণের মতো পালন করে যাই বাড়ির সংসারের কল্যানার্থে।
"বুরা গিয়া ভালা আ
অলক্ষ্মীকে তাড়াইয়া লক্ষ্মী আ।
যা যা মশা মাছি উইড়া যা
আমগো বাড়িত্যে অমুকের বাড়ি যা।"
হেমন্তের ধানে ফলন বহুগুন বৃদ্ধি পাবার জন্য প্রধানত এই ব্রত করা হয় বলে প্রাচীন কিছু গ্রন্থে বলা আছে।আসলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এটাই ছিল রীতি, যে পূজা প্রার্থনার মাধ্যমে মৃত্তিকাকে আরও উর্বর করে তোলা। মাটি খুঁড়ে গাড়ুর ডাল ঢেলে মাটি আবার বুজিয়ে দেবার রীতিই হয়ত এই কারণেই।
যে গাড়ুর ডাল এইদিন করা হয় তা রান্না করা হয় আশ্বিনের শেষ দিনে আর খাওয়া হয় কার্তিকের সারা দিন ধরে। এমনকি পূর্ববঙ্গের ঘরে ঘরে প্রচলিত আছে যে এই ডাল একা খাওয়া যায় না, পাড়া প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বাটি ভরে প্রসাদের মতো প্রথার মতো বিতরণ করাও হয় এই ডাল। নানান রকম সবজি, নারকেল,খেসারির ডাল সহযোগে এই রান্না শুধু অমৃতই না বলা যায় পুষ্টিকরও। এই ডালকে অনেকেই আসম্বারী ডালও বলে থাকেন। এই ডাল রান্নায় কোনো ভবেই হলুদ বা তেল ব্যবহার করা হয় না।কোনো ফোড়নও দেওয়া হয় না।
কোনো কোনো জায়গায় নিমপাতা এবং হলুদ বেটে সেটা দিয়ে স্নান করে বাড়ির সমস্ত সদস্য। আবার কোথাও কোথাও এই রান্না করতে বসে পড়লে আর ওঠা যায় না এমন নিয়মও আছে। তবে সত্যি বলতে কি আজকাল সেভাবে নিয়ম মানা হয় না কারণ আজকাল মানুষের শরীর আগের মতো নেই। সম্পূর্ণ নির্জলা উপবাস থেকে কারোর পক্ষেই আর সম্ভব হয় না সম্পূর্ণ সময় থাকার। অন্তত ওষুধ খাবার জন্যও বাড়ির মা বউদের জল খেতেই হয়।
এবার রান্নায় আসি।
পদের নাম -- গাড়ুর ডাল
উপকরণ - আঠাশ রকম সবজি। প্রধান হল আট রকম। তারপর যে যতটা পারেন যুক্ত করেন।
প্রধান আট রকম সবজি হল -- শাপলা শালুক চালকুমড়া কুমড়ো গাঠিকচু থোড় মূলো এবং আলু। এরপর পেঁপে ঝিঙে শোলাকচু বরবটি পটল বেগুন এরকম ইচ্ছেমতো সবজি দেওয়া যায়।
উপকরণ বলতে আর কয়েকটি জিনিস তা হল খেসারির ডাল বা মটর ডাল, ঘি,নারকেল কোড়া
পদ্ধতি -- প্রথমে পরিমাণ মতো ডাল নিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে, তারপর প্রেসার কুকারে দুটো সিটি দিয়ে ডাল সেদ্ধ করে নিতে হবে নুন দিয়ে। এরপর কাটা সবজি ভালো করে ধুয়ে ওই ডালের মধ্যে দিয়ে আরও একবার সেদ্ধ করে নিতে হবে। সবজি এবং ডাল ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে গেলে স্বাদ অনুযায়ী নুন কোড়ানো নারকেল এবং ঘি দিয়ে আরও মিনিট দশেক ফোটালেই তৈরি গাড়ুর ডাল।
অপূর্ব এর স্বাদ, প্রাচীন এর ব্রত কাহিনি।