top of page

'দাইল-শুক্তা' রান্না আর বাঙালির ডালশস্যের ইতিহাসে মুঘলদের ডালপ্রীতি

"দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ, দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল; ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়,ছিঁড়ে দেবে চুল দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ, দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ। বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ! দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।" 'কাজের ছেলে' -- যোগীন্দ্রনাথ সরকার বাংলা আর বাঙালি যেখানেই,সেখানে দুপুরের ভাতের থালায় পাতলা ডাল আর রাতে ঘন ডালের তরকারি তো চিরকালীন সত্য। ভাত আর বাঙালি যদি ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত হয় তাহলে ডালও সেই নিয়ম লঙ্ঘন করেনি কোনোও কালেই। মধ্যবিত্ত পরিবার হোক অথবা উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত দুপুরে ভাতের সাথে ডাল অপরিহার্য। অতি প্রাচীন কাল থেকে যখন থেকে অনুষ্ঠানপর্বে নিমন্ত্রণ বিষয়টি উঠে এসেছে তবে থেকেই বাঙালির উচ্চারণ থেমে গেছে "আগামীকাল আমার বাড়িতে দুটো ডালভাত গ্রহণ করবেন " এখানেই। ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করলে আমার আপনার চোখের সামনে উঠে আসে এরকমই কিছু নস্টালজিক বাক্য বা শব্দবন্ধ। ডালভাতও যেন সেরকমই একটি আব্দারের নাম। শিশু, ঝাল খেতে পারে না"ওকে ডালভাত চটকে দাও" আবার কোনো বয়ঃজ্যেষ্ঠ, যার হজম ক্ষমতা কমে গেছে-- "মেসোমশাই,আপনাকে ডাল ভাত আর গরম গরম মাছ ভাজা দিই?"। এইই তো যুগে যুগে বাঙালির আদি কথা। ডাল। আদি। অকৃত্রিম। ডাল মূলত শিম্বি গোত্রীয় ফলের বীজ। মটর মুগ মুসুর খেসারি বিউলি অড়হড় কত রকম ডাল। প্রোটিন সমৃদ্ধ এই খাদ্যকে গরীবের আমিষও বলেই কেউকেউ। প্রোটিন ছাড়াও লাইসেন বিভিন্ন খনিজ ফাইবার সমৃদ্ধ ডালের পুষ্টিগুণ এতটাই বেশি যে শরীর সুস্থ রাখতে ডাক্তারদের বরাবরের ভরসার জায়গা নানাপ্রকার ডাল। সেদ্ধ করে হোক বা মশলা ফোড়ন রকমারি উপায়ে রান্না করা যায় ডাল জাতীয় শস্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তখন সিংহাসনে। সময়টা আনুমানিক ৩০৫ খ্রীস্টপূর্ব। রাজার বিবাহ। মেনুতে ঘুগনি ডাল। হ্যাঁ, ঠিক যে ঘুগনি ছাড়া জমে না লুচি পরোটা বা সান্ধ্যকালীন আড্ডা সেই ঘুগনি। গোটা মটর সেদ্ধ করে তাতে নানাবিধ মশলা ফোড়ন সহযোগে তৈরি ঘুগনি। আজও বাংলার অনেক বাড়িতে পয়লা বৈশাখে মিষ্টান্ন বিনিময়ের সাথে সাথে বিনিময় হয় এক বাটি ঘুগনি। ইতিহাস বলে ভারতবর্ষে ডালের আগমন সিন্ধু সভ্যতারও অনেক আগে। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইবন বতুতা ভারতে আসার পর যে ভ্রমনবৃত্তান্ত লেখেন সেখানে মুগ ডাল আর চাল দিয়ে ‘খিশ্রি’ র উল্লেখ পাওয়া যায়। আবুল ফজলের লিখিত বই 'আইন-ই-আকবরি’ তে সাত রকম খিচুড়ির পদ্ধতি জানা যায়। হুমায়ুন যখন শের শাহ- র কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে পারস্যে আসেন তখন তিনি কৌশল করে রীতিমতো নিমন্ত্রণের মাধ্যমে শের শাহ'র আশ্রয় জিতে নিয়েছিলেন, নেপথ্যে ছিল অমৃত স্বাদের খিচুড়ি কাহিনি। মুঘল রাজাদের খিচুড়ি প্রীতি ইতিহাস ভালোবাসা কমবেশি সকল মানুষই প্রায় জানেন। মহাপরাক্রমশালী ঔরঙ্গজেব যে নিরামিষভোজী ছিলেন আর তাঁর প্রিয় খাদ্য যে খিচুড়ি ছিল তা জানা যায় ইতিহাস ঘাঁটলে। তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুঘলরা বাঙালিদের ওপর প্রভাব বিস্তারের অনেক আগে থেকেই বাঙালি মজে আছে ডাল আর ডালের তরকারিতে। এই যেমন, যদি বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়-এর 'পাকপ্রণালী' দেখি,তাহলে দেখব "দাইল প্রকরণ” নিয়ে অনেক কথা লেখা আছে,খুব সহজেই অনুমেয় যে এই দাইল ~ ডাইল~ ডাল। এই মহামূল্যবান বইটিতেই "সাজাহানী ধরণে দাইল পাক” বলতে যে রান্নার কথা লেখক বলতে চেয়েছেন তা মূলত বর্তমান যুগের ডাল মাখানি হবার চান্স আশি শতাংশ। আবার মেওয়ারের রাজ পরিবার থেকে এসেছে পঞ্চরত্ন ডাল রান্নার ধারণা যাকে পাঁচমেলও বলা হত। শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেব দুজনেই এই শাহী পঞ্চরত্ন ডালের ভক্ত ছিলেন। মহাভারতেও পাওয়া যায় এই ডালের নাম। ভীমসেন নিজের হাতে ধীর আঁচে মাটির পাত্রে এই পঞ্চরত্ন ডাল বানাচ্ছেন নিজে খাবেন বলেই এবং রান্না শেষ হলে গরম অবস্থাতেই পরিমাণ মতো ঘি ঢালছেন। এসব পৌরাণিক কাহিনী এবং তাদের সাথে জড়িত ইতিহাস প্রমাণ করে যুগে যুগে ডালের মাহাত্ম্য মোহময় করে তুলেছে ভারতবর্ষের সমস্ত রান্নাঘর। ডালের কথা যখন উঠলোই তখন পাশ্চাত্যের স্যুপ বর্ণনা না করলে কিছু একটা যেন 'অধুরা' থেকে যায়। এই স্যুপ আর ডাল যেন 'একই মায়ের পেটের দুই ভাই'। একজন সাদা তো অন্যজন হলুদ। গরম গরম খেলে দুটোই অসম্ভব সুস্বাদু, বিশেষ করে রুগীর পথ্য হিসেবে তো ডাল এবং স্যুপ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এখন প্রশ্ন হল বিদেশি স্যুপকেই কেন ডালের পরবর্তী রূপ বলা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা। মহাভারতের আদিপর্বে এসে আমরা দেখি বশিষ্ঠ নন্দিনী নামের কামধেনুর কাছে ঋষি বিশ্বামিত্রের আহারের জন্য যে অন্ন-সূপ-মিষ্টান্ন-মদ্যের প্রার্থনা করছেন সেখানে এই সূপ যে বাঙালির ডালই তা বুঝতে বাকি থাকে না। ইতিহাস গেল এবার খাবার পাতে আসুক আজকের 'দাইল-শুক্তা' বা 'ডাল-শুক্তো' উপকরণ -- সেদ্ধ ছোলার ডাল, উচ্ছে, লাউ, আদা-রাঁধুনি-তেজপাতা একসাথে বাটা, ঘি, ফোড়নের জন্য শুকনোলংকা তেজপাতা কালো সর্ষে, রাঁধুনি পদ্ধতি - উচ্ছে চাক চাক গোল করে কেটে মাঝারি আঁচে হালকা ভেজে নিতে হবে। লাউ ডুমো ডুমো করে কেটে ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। সেদ্ধ করা ছোলার ডালে পরিমাণ মতো নুন হলুদ মিষ্টি এবং কাটা লাউ দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে অন্তত পনেরো মিনিট। এবার কড়াইয়ে তেল দিয়ে তাতে তেজপাতা শুকনো লংকা রাঁধুনি কালো সর্ষে ফোড়ন দিয়ে বেটে রাখা মশলা দিয়ে মিনিট পাঁচেক কষিয়ে ভেজে রাখা উচ্ছে দিয়ে সাৎলে নিয়ে সমগ্র মিশ্রণটা ঢেলে দিতে হবে সেদ্ধ করে রাখা ছোলার ডাল আর লাউয়ের পাত্রে। এবার মিনিট পাঁচেক ফুটিয়ে ওপর থেকে এক চামচ ঘি ছড়িয়ে দিলেই তৈরী ডাল-শুক্তো





Recent Posts

See All

কালী কলকাত্তাওয়ালী

কলকাতা মানেই কালী। আর তাই কালী কলকাত্তাওয়ালী। প্রচলিত এই বাক্যবন্ধই বুঝিয়ে দেয় যে কলকাতা আর কালীর সম্পর্ক কতটা প্রাচীন। কিন্তু কোথায় সেই কলকাতার কালী। জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতায় কালীই পূজিতা। আর সেক্ষেত্রে য

bottom of page