top of page

নেপথ্যের প্রজ্ঞাসুন্দরী এবং ঠাকুরবাড়ির মুগপটল - পিয়াংকী

রন্ধনী। হেঁশেল বিশারদ বললেও খুব ভুল হয় না, প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবী, ঠাকুরবাড়ির এক উজ্জ্বল অধ্যায়,এক নেপথ্যের গল্প। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার স্ত্রী নৃপময়ীদেবীর আট সন্তানের মধ্যে মধ্যমকন্যা প্রজ্ঞা। যেমন নাম তেমনই তার কাজকর্মের নমুনা। নারীর আবেগ এবং অনুভব যেখানে প্রতিনিয়ত জন্ম নেয় সেই অতি সাধারণ হেঁশেলে তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। কিন্তু যাতায়াত তো সকলেরই থাকে,নিত্যনৈমিত্তিক পাঁচ পদ রান্না, খেতে দেওয়া তারপর নুন কম ঝাল বেশির ফিরিস্তি শুনতে শুনতে বয়ে যায় বেলা, এ তো কমবেশি প্রতিটি মেয়েরই জীবনরচনা।

প্রজ্ঞা কিন্তু এমনটা নন।তিনি স্থিতধী, তিনি উদ্যমী তিনি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আজকের মতো ক্রিয়েটিভ। রান্নাঘরকে যিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন এক কর্মশালা, যজ্ঞপাত্র। আসলে প্রজ্ঞার মেধার প্রতিফলন ঘটেছে তার বাবার রসায়ন চর্চা এবং মায়ের রঙতুলির মিশেলে। খুব সহজ উপায়ে এবং সহজপাচ্য খাবার তৈরিই ছিল তাঁর রান্নার মূলমন্ত্র।


ইংরেজি ১৮৮৪ সালে জন্মানো এক মেয়ের ভেতরের আগুন সেদিন সেভাবে কেউ না বুঝলেও সেভাবে কেউ আলোচনা না করলেও আজ একবিংশ শতাব্দীর সময়কালে এসে বোঝা যায় কী অসম্ভব রুচি এবং বুদ্ধি ছিল তাঁর যা একত্রিত হয়ে রূপ দিয়েছে হাজার খানেক রেসিপিতে। অথচ কাকা রবীন্দ্রনাথ যিনি ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক বলা চলে, যার দর্শন নিয়ে ভেবেছে সারা পৃথিবী সেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর কোনো লেখায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবীকে নিয়ে কিছু লিখে রেখে যাননি।

আশ্চর্য বিষয় হল কাকাবাবু রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে ভাইঝি প্রজ্ঞা তৈরি করেছিলেন একটি বিশেষ পদ যার নাম "কবি সম্বর্ধনা বরফি"। আগত অতিথিরা খেয়ে বুঝতেই পারেননি এই বরফি কোনো দুধ ছানা মালাই বা নারকেল জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি নয়,এর মূল উপকরণ হল ফুলকপি। এহেন প্রজ্ঞা যে নিজের নামকে কাজের সাথে একই সরলরেখায় মিলিয়ে ফেলবেন সে আর বড় কী।

আজ থেকে অন্তত একশো বছর আগে ১৩০৭ বঙ্গাব্দে প্রজ্ঞাসুন্দরীর ব্যক্তিগত খেরোর খাতা থেকে উঠে আসা প্রণালীরা ছাপার অক্ষর আকারে আসে " আমিষ ও নিরামিষ আহার " এটি ছিল প্রথম খণ্ড। বাংলার ইতিহাস বলে এটিই ছিল প্রথম মুদ্রিত রান্না বিষয়ক গ্রন্থ। এরপর অবশ্য তিনি আরও একটি বই লেখেন,যেখানে আমিষ আরও অনেক পদের সংযোজন হয়,সেই বইটির নাম "আরও আমিষ"। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এই যে আমাদের বাঙালিদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে যা প্রায় প্রবাদের আকার নিয়েছে সেটি হল, 'সব পুরুষের পেছনে একজন নারী থাকে'। প্রজ্ঞাদেবীর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অন্তত এই নিবন্ধের লেখক হিসেবে আমার মত, প্রত্যেক সফল নারীর পেছনে সর্বদা একজন পুরুষ অবস্থিত। মতামত অবশ্যই ব্যক্তিগত। তবু বলতে পারি যে পুরুষ সমকালীন সমাজ এবং রীতিপ্রথার উর্ধ্বে উঠে একজন পাশ্চাত্য শিক্ষায় গড়ে ওঠা মেয়েকে আত্মীয় এবং স্বজনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারেন তিনিই বোধহয় প্রকৃত অর্থে পুরুষ। এই পুরুষটিই হলেন প্রজ্ঞাদেবীর স্বামী অসমীয়া সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া। প্রজ্ঞাসুন্দরীর বই তৈরির ইতিহাসে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে আড়ালে।


ফুলকপি খোয়াক্ষীর জাফরান সোনারূপোর তবক দিয়ে তৈরি " কবি সম্বর্ধনা বরফি " যেমন অমাবস্যার আকাশে চাঁদ ঠিক তেমনই "রামমোহন দোলমা পোলাও" "দ্বারকানাথ ফিরনি পোলাও " ও ওঁরই সৃষ্টি। অভূতপূর্ব এই সৃষ্টি এবং তার স্রষ্টাকে প্রণাম জানাই যাঁর মাধ্যমে আজ খুলে গেছে রান্নার দিগ্বিদিক।

মূলত ঠাকুরবাড়ির রান্না ট্যাগ লাইনে যে ধরণের রান্না পাওয়া যায় তার অনেকটাই প্রজ্ঞাসুন্দরী বেজবড়ুয়ার সৃষ্ট সন্তান। শুধু রান্না নয় ওঁর বই পড়লে ঘরোয়া কাজ গোছানো সম্পর্কেও অনেককিছু জানা যায়। জানা যায় কিভাবে সামান্য টোটকা ব্যবহার করে রান্নার গুণগত মান আরও বাড়ানো যায়,জানা যায় কিভাবে মেকওভার করা যায় একটা পরিপাটি বাড়ির। এত গুণী একজন মানুষ যিনি শুধু রান্না নয় লিখেছে গল্প কবিতা প্রবন্ধ এমনকি সম্পাদনা করেছেন "পূণ্য"নামের একটি পত্রিকার। যে পত্রিকাটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রিকা যা রান্না বিষয়ক গবেষণা প্রকাশ করত। প্রজ্ঞাসুন্দরী সমেত আট ভাইবোন মিলে তাঁরা সেইসময় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকে প্রকাশ করতেন এই পত্রিকা।


প্রজ্ঞাসুন্দরীকে নিয়ে যত বলা যায় ততই কম। সেভাবে তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়নি বাংলায় যা খুবই দরকার ছিল। আজ তাঁরই সৃষ্ট একটি রান্না পরিবেশন করব যা অতীব সুস্বাদু এবং সহজপাচ্য।


রান্নার নাম -- মুগপটল


উপকরণ -- মুগডাল,পটল,আদাবাটা, জিরেবাটা,কাঁচালংকাবাটা, তেজপাতা, শুকনোলংকা, গোটা জিরে, দুধ,ঘি, নারকেলকোরা


পদ্ধতি - ভীষণ সোজা,যে কেউ এই রান্নাটি করতে পারবেন, যাঁরা সেভাবে রান্না জানেন না, সময়ও থাকে না অনেকক্ষণ ধরে রান্না করার তাদের জন্যও এই রান্নাটি একদম পার্ফেক্ট।


পরিমাণ মতো মুগ ডাল নিয়ে কাঠখোলায় অর্থাৎ শুকনো খোলায় (যাকে বলে কড়াইতে তেল ছাড়া) ভেজে নিতে হবে হালকা বাদামী করে। এরপর কাঁচালংকা আদা এবং জিরে একসাথে করে শিলে বেটে নিতে হবে মিহি করে। তারপর পটল কেটে নিতে হবে যেভাবে পটলভাজা হয় তেমন শেপে। রান্নার প্রথমে ভাজা ডাল জল পাল্টে পাল্টে ধুয়ে পরিস্কার করে সেদ্ধ করতে বসাতে হবে, ৫০% সেদ্ধ হয়ে এলে পটলগুলো দিয়ে দিতে হবে। গ্যাসের তাপমাত্রা কমিয়ে ঢাকা দিতে হবে পাঁচ মিনিট সময়ের জন্য। এরপর ঢাকা খুলে বাটা মশলাটা সরাসরি দিয়ে দিতে হবে পাত্রে,আবার মিনিট পাঁচেক ফুটলে গ্যাসের ওভেন থেকে সরিয়ে রেখে ওভেনে একটা পরিস্কার কড়াই বসিয়ে ফোড়ন তৈরি করতে হবে, সর্ষের তেল দিয়ে তাতে গোটা শুকনো লংকা তেজপাতা সামান্য জিরা দিয়ে ভেজে সুন্দর গন্ধ বেরোলে সেটা ঢেলে দিতে হবে ফুটিয়ে রাখা ডালে, এইসময় দিতে হবে সরদুধ অর্থাৎ ঘন খাঁটি দুধ। এক কাপ পরিমাণ দুধ অল্প নারকেলকোরা দিয়ে সামান্য ফুটে উঠলেই কমপ্লিট রান্না। এবার গ্যাস বন্ধ করে নামানোর আগে অল্প ঘি ওপর থেকে ছড়িয়ে মিশিয়ে নিলেই তৈরি মুগপটল। ঘি দেবার পর চাপাঢাকা দিয়ে রাখতে হবে গরম অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ।

গরম ভাতের সাথে অথবা রুটির সাথে অথবা রুগীর মুখের স্বাদ ফেরাতে এবং পথ্য হিসেবে খুব উপকারী প্রোটিন সমৃদ্ধ এই মুগপটল |


Recent Posts

See All

কালী কলকাত্তাওয়ালী

কলকাতা মানেই কালী। আর তাই কালী কলকাত্তাওয়ালী। প্রচলিত এই বাক্যবন্ধই বুঝিয়ে দেয় যে কলকাতা আর কালীর সম্পর্ক কতটা প্রাচীন। কিন্তু কোথায় সেই কলকাতার কালী। জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতায় কালীই পূজিতা। আর সেক্ষেত্রে য

bottom of page