আজ বিজয়া দশমী। শারদীয় অন্তিমসময়। কেমন যেন কান্নার শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে মনের অন্তরমহলে। তবু, ছেড়ে দেওয়াই রীতি। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে সবকিছুই ফিরে যায়,অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তীর জন্য। দুর্গাপূজাও এর ব্যতিক্রম নয়। আজ দেবীর কৈলাশে ফিরে যাবার সময়। আজ মাতৃমূর্তির বিসর্জন। মাটির তৈরি মূর্তি গঙ্গায় ভাসিয়ে সেই মাটিতেই তাকে প্রতিস্থাপিত করার এই রীতি প্রাচীন। বিসর্জন কথার অর্থ হল "বিশেষরূপে সৃজন "। অর্থাৎ দেবীকে নিজ অন্দরে স্থান দেওয়া।আদির সাথে অন্তের মিলন। পুরাণ অনুযায়ী, শুক্লা দশমীর এই তিথিতে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন, তাই এই দিন বিজয়া দশমী হিসেবে চিহ্নিত। মহাভারতের কাহিনি অনুযায়ী বিজয়া দশমীর আরও একটি তাৎপর্য আছে। দীর্ঘ ১২ বছর অজ্ঞাতবাস শেষে আশ্বিন মাসের এই শুক্লা দশমী তিথিতেই পাণ্ডবরা শমী বৃক্ষে লুকিয়ে রাখা তাদের অস্ত্র পুনরায় উদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় সম্মুখে আনতে পারেন। এভাবেই নানাবিধ কারণে দুর্গাপূজার এই দশমী তিথি উল্লেখযোগ্য। পুরাণ হোক বা ঐতিহাসিক যুক্তি মানসিক আধার বলে একটি শব্দ, তা হল 'বিষাদ'। আজ সকলের মুখে বিষাদী হাওয়া। সেই সাথে দেবীকে ফিরিয়ে দেবার রাজকীয় তোড়জোড়। পান্তাভাত থেকে কচুরশাক, ইলিশভাজা থেকে তিলখইনাড়ু। রকমারি বাহারি পঞ্চব্যঞ্জনে সাজিয়ে মা'কে শেষ বিদায়। আজ মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলা দেবী বরণ। আজ দশমীর দিনে অপরাজিতা পূজা একটি বড় অংশ। দেবীর অনেক নামের মধ্যে একটি নাম হল অপরাজিতা। পুরাণ মতে, অপরাজিতা দেবী ত্রিনয়না এবং নীলবর্ণা চন্দ্রকলা সম্বলিত। দুর্গামা বিসর্জনের দিকে এগিয়ে যাবার পর পূজামণ্ডপের ঈশান কোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতা লতা পেঁচিয়ে পুজো করা হয়। একটা পূজার সাথে জড়িত থাকে কত কথা, কত কাহিনী। শোনা যায়, রাণী রাসমণির জামাতা মথুরবাবু একবার আচমকা দশমীর দিন রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর কাছে উপস্থিত। দশমীতে ঠাকুর বিসর্জন না করার বায়না নিয়ে। কিছুতেই তিনি মা'কে ওই গঙ্গার জলে ভাসান দেবেন না। রামকৃষ্ণ অনেক বোঝান, কিছুতেই কাজ হয় না। কিন্তু তিনি স্বয়ং রামকৃষ্ণ। তাঁর উপলব্ধিতে জগৎ সংসারের পা ফেলা। তিনি বললেন,মা কোনোদিন সন্তানদের ছেড়ে থাকতে পারেন না। তিনি এতদিন সম্মুখে পূজা নিয়েছেন বহির্দৃশ্যে, আজ থেকে তিনি অন্তরের কুঠুরিতে বসে প্রতিদিন পূজা গ্রহণ করবেন। মা,কখনো সাকার কখনো নিরাকার। মথুরবাবু এই যুক্তিতে নিজেকে উন্নীত করলেন। এরকম কত কাহিনী। দশমীর আরেকটি বিশেষ রীতি হল সিঁদুর খেলা। কেন খেলা? কেন সিঁদুর নিয়েই এই আচার? পুরাণ বলে আমাদের কপালে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অবস্থান করেন। আদি অনন্ত কাল থেকে মাটির সাথে জলের সাথে বাতাসের সাথে সর্বোপরি প্রকৃতির সাথে বাংলার সমস্ত আচার অনুষ্ঠান নিয়মরীতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। লাল রঙ হল সৃষ্টির প্রতীক। সাধনার প্রতীক। হিন্দুশাস্ত্র মেনেই তাই ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য এবং যেহেতু নারী সন্তানের জন্মদাত্রী, সৃষ্টির আদি তাই প্রসাধনী ব্যবহারের মাধ্যমে দেবীর পুজো। হিন্দুশাস্ত্র মতে, বিবাহিত নারী সিঁথিতে সিঁদুর পরলে স্বামীর আয়ুবৃদ্ধি হয়,সংসারে সুখ বজায় থাকে। তবে সিঁদুর খেলার এই ইতিহাস কিন্তু অনেক প্রাচীন। কারোর মতে ৫০০ বছরের পুরোনো এই রীতি। কারোর মতে ২০০। দুবরাজপুরে সিঁদুর খেলা মহাসপ্তমীতেই অনুষ্ঠিত হয়। আজ বাঙালিদের মধ্যে লৌকিক এক রীতিও প্রচলিত। দশমীর ঘট স্থাপন এবং পুঁটিমাছকে ধানদূর্বা হলুদ সিঁদুর সহ বরণ করে ঘরে তুলে বাড়ির দক্ষিণপূর্ব কোণে ইঁদুরের মাটি উঠেছে এমন জায়গায় সেই জোড়াপুঁটি পুঁতে দেওয়া। কারোর কারোর বাড়িতে এই জোড়াপুঁটি দুপুরের ভাতের পাতে খাবারও প্রচলন রয়েছে আজ বিজয়ের দিন। আজ মাছ-মিষ্টির দিন।
পদ -- পমফ্রেট সেঁকা
উপকরণ -- পমফ্রেট মাছ, নুন, হলুদ,দই,গোলমরিচগুঁড়া, সর্ষের তেল, পাকালংকাবাটা, পাতিলেবুর রস, রসুনবাটা, ধনেপাতাবাটা
পদ্ধতি -- মাছ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে জল সম্পূর্ণভাবে ঝরিয়ে নিতে হবে। এরপর উল্লিখিত সমস্ত মশলা একসাথে মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে মাছের গায়ে খুব যত্ন করে ঘষে ঘষে মাখাতে হবে৷ মাখানোর আগে মাছের গা দুটো দাগে চিরে নিলে মশলা ভালো করে ঢুকবে। এরপর কড়াই গরম করে তাতে দুচামচ মতো তেল দিয়ে পাত্রের সারা গায়ে ঘুরিয়ে নিয়ে একে একে মাছগুলো দিয়ে দিতে হবে।তাপমাত্রা থাকবে মাঝারি। মিনিট পাঁচেক পর উল্টো দিকে আরও পাঁচ মিনিট রান্না করলেই তৈরি সেঁকা পমফ্রেট
পদ -- কালোজিরেবাটা পার্শে উপকরণ -- পার্শেমাছ, নুন, হলুদ,সর্ষের তেল,কালোজিরে এবং কাঁচালংকা একসাথে বাটা পদ্ধতি -- পার্শে মাছ ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে পনেরো মিনিট। এরপর কড়াইতে তেল দিয়ে মাছ ভালো করে ভেজে তুলে রাখতে হবে। বাকি তেলে বাটা মশলা দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে হবে,মিনিট তিনেক কষালেই তেল ছেড়ে আসবে সেই সময় হাফ কাপ গরম জল দিয়ে ফুটিয়ে মাছগুলো দিয়ে আরও পাঁচ মিনিট ফোটালেই তৈরি রান্না পদ-- চিংড়িভাঁপে উপকরণ -- চিংড়ি, সসর্ষেবাটা, কাঁচালংকাবাটা, নারকেলবাটা,সর্ষের তেল পদ্ধতি -- মাছ ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে পনেরো মিনিট। এরপর সমস্ত বাটা মশলা এবং কাঁচা মাছ একসাথে মেখে নিয়ে একটা টিফিন কৌটোতে রেখে ওপর থেকে কাঁচালংকা চেরা দিয়ে কৌটোর মুখ বন্ধ করে ভাঁপে সেদ্ধ করতে হবে কুড়ি মিনিট। একটা কড়াইতে জল দিয়ে তার ওপর টিফিন কৌটো বসিয়ে ওপর থেকে একটা উঁচু চাপাঢাকনা দিয়ে ভাঁপাতে হবে কুড়ি মিনিট ---- আবার এক বছরের অপেক্ষা। মায়ের ভাসান মানে অন্তরে মননে মাকে প্রতিস্থাপন। সকলকে বিজয়ার শুভেচ্ছা শুভকামনা অভিনন্দন।