top of page

রাধানাথ শিকদার - বাঙালীর আত্মবিস্মৃত অধ্যায়

ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ আজকের বিষয় নয় মোটেই। ছিল আজ থেকে দুশো বছর আগেও। আর চিরকালই স্কলার ছাত্রদের ডেকে কাজে বহাল করেছে দেশি বিদেশি কোম্পানিগুলো। সাল ১৮৩১। গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তৎকালীন সুপারিন্টেন্ডেন্ট জর্জ এভারেস্ট দ্বারস্থ হলেন কলকাতার হিন্দু কলেজের গণিত শিক্ষক ও তখনকার কলকাতার বিখ্যাত শিক্ষাবিদ জন টাইটলারের কাছে। টাইটলার সাহেব তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলেন একজন ঝকঝকে নব্য যুবকের নাম। যে যুবক সেই বয়সেই পড়ে ফেলেছে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া। যে যুবক সদ্য ডিরোজিওর থেকে নিয়েছে বেঙ্গল রেনেসাঁসের মন্ত্র। যে যুবক মাত্র সতেরো বছর বয়সে কলকাতার টাউন হলে শেক্সপিয়ারের 'অ্যাস ইউ লাইক ইট' নাটকে ওরল্যান্ডোর সংলাপ বলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিনি রাধানাথ শিকদার। জন্ম ১৮১৩ সালে, কলকাতায় শিকদার পরিবারে। আধুনিক ভারতের প্রথম বাঙালি গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী হিসাবে তাঁর বুৎপত্তি। তিতুরাম শিকদার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধানাথ ও কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীনাথকে বাঙালি খ্রিস্টান কমল বসুর স্কুলে পড়াবার পরে সরাসরি ভর্তি করে দিলেন হিন্দু কলেজে। দুই ভাইয়ে বয়সের ফারাক ২ বছর। দুজনেই অসম্ভব মেধাবী। হিন্দু কলেজে তখন দাপিয়ে শিক্ষকতা করছেন বিখ্যাত পাস্কাল, মোলিস, রস ও টাইটলার সাহেবদের মতো শিক্ষকেরা। এরপর ১৮২৬ সালে চতুর্থ শ্রেণীতে থাকাকালীন ডিরোজিওর সাহচর্যলাভ। ডিরোজিওর নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত মাত্র ১৯ বছরের রাধানাথ তাঁর প্রিয় শিক্ষক পরামর্শ মতো জয়েন করলেন জি.টি.সার্ভে অফিসে। অর্থাৎ জর্জ এভারেস্টের নেতৃত্বাধীন 'গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'য়। পোস্টিং দেরাদুনে। কাজ বলতে গণিতের মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কোম্পানির অধিকৃত জায়গার জরিপ ও পরিমাপ। এখনও উত্তর চব্বিশ পরগনার সুকচরে বিটি রোডে অথবা উত্তর কলকাতায় টালা দিয়ে যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাঁরা নিশ্চয় বর্গাকৃতি সুউচ্চ পরিত্যক্ত মিনারগুলির দিকে একবার হলেও তাকিয়েছেন। কখনও হয়ত মনে প্রশ্ন জেগেছে এগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে। বলে রাখি, সেগুলোও ১৯৩১ সালে তৈরি করেন জিটিএস কর্ণধার জর্জ এভারেস্ট সাহেব। উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন স্থানে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে গণিত পদ্ধতিতে জরিপ কার্য। এইসব মিনারগুলি থেকে রাতের অন্ধকারেও জমি জরিপের আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো সেযুগেও। রাধানাথ ছিলেন তারই অভেদ্য অঙ্গ। স্বয়ং এভারেস্ট সাহেব কর্মযোগী রাধানাথের অফিস থেকে ছুটি নেওয়ার আবেদন প্রসঙ্গে তাঁর বাবা তিতুরামকে চিঠিতে লিখছেন- "I wish I could have persuaded you to come to Dehra Dun for not only it would have given me the greatest pleasure to show you personally how much I honour you for having such a son as Radhanath". তৎকালীন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সার্ভেয়ার হিসাবে পরিচিত এভারেস্ট সাহেবের এই চিঠির বয়ানই রাধানাথের মেধা ও কর্মদক্ষতার আসল পরিচয় বলে দেয়। রাধানাথই ছিলেন প্রথম বাঙালী যিনি সর্বপ্রথম সার্ভে কাজে নিযুক্ত হন। জর্জ এভারেস্টের অবসরগ্রহণের পরে জিটিএসের অধিকর্তা হয়ে আসেন অ্যান্ড্রু ওয়াঘ সাহেব। ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জিটিএস সম্বন্ধীয় রিপোর্ট পেস করবার সময় তিনিও রাধানাথ শিকদারের প্রসঙ্গ আলাদা করে উল্লেখ করেন। তখন রাধানাথ অফিসের 'চিফ কম্পিউটার' পদে প্রমোশন পেয়েছেন। তখন তিনি সার্ভে দপ্তরের রীতিমতো উচ্চপদস্থ অফিসার। আজকের যুগ হলে কয়েকটি সেরা বাঙালী পুরস্কার ও স্বীকৃতি তাঁর ঝুলিতে অবধারিতভাবে বাঁধা থাকত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেযুগে ব্রিটিশ ভারতে তেমন কিছুই পাননি বাঙালী কৃতি বিজ্ঞানী রাধানাথ। আজ ক'জন বাঙালী তাঁর কর্মকান্ড সম্বন্ধে অবহিত তাও হাতে গুনে বলা যায়। ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের এই কৃতি সন্তান হিমালয়ের ১৫ নং শৃঙ্গকে (তখন মাউন্ট এভারেস্টকে এই নামেই চেনা হতো) পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসাবে আবিষ্কার করার পরেও সুপারিন্টেন্ডেন্ট অ্যান্ড্রু ওয়াঘের সুপারিশে সেই শৃঙ্গের নামকরণ পর্যন্ত করা হয় জর্জ এভারেস্টের নামে। অথচ রাধানাথ যখন এই দুরূহ কাজটা করে ফেললেন তখন এভারেস্ট সাহেব কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে বিলেত ফিরে গেছেন। অর্থাৎ এই কাজে তাঁর বিন্দুমাত্র ভূমিকা পর্যন্ত ছিল না। এভাবেই ব্রিটিশ ভারতে চির-উপেক্ষিত ছিলেন রাধানাথ। বাতাসে বায়ুমণ্ডলে আলোর প্রতিসরণের সঠিক হিসাব কষে রাধানাথ একেবারে নির্ভুল ভাবে নিরুপন করে ফেলেছিলেন মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতার ফারাকে আলোর প্রতিসরণগত পার্থক্য বুঝে তিনি এভারেস্টের উচ্চতা মাপেন ২৯০০২ ফুট। ১৯৫৫ সালে আরেকটি দল এই শৃঙ্গের উচ্চতা নিরূপণ করেন, বলাই বাহুল্য, তাতেও বেরোয় ২৯০২৯ ফুট।

হিন্দু কলেজের রাধানাথ নিজের মেধার জোরে ১৬ টাকা বৃত্তি পেয়ে বই কিনতেই সবটা ব্যয় করে ফেলতেন। সেই সময় কলেজের অধ্যক্ষ কমিটির সদস্য ডেভিড হেয়ার সাহেব বিভিন্ন গণিত বিষয়ক বই দিয়ে তাঁকে নিয়মিত সাহায্য করতেন বলে জানা যায়। এরপর ৩০ টাকা বেতনে জিটিএসের কর্মজীবন তাঁকে শেষ পর্যন্ত ৬০০ টাকা বেতনের উচ্চপদস্থ অফিসারে পর্যবসিত করে। গণিত ছাড়াও ইংরেজি, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় তাঁর দখল ছিল চোখে পড়বার মতো। আর একটি কথা না বললেই নয়। আজকের খবরে আবহাওয়ার দৈনিক যে পূর্বাভাস শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, কলকাতায় প্রথম তাঁর প্রচলন করেন রাধানাথই। ১৮৫২ সালে তিনি ট্রান্সফার হয়ে আসেন কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের সন্নিকটে আবহাওয়া অফিসে। ১৮৫৩ সালে তিনিই প্রথম দৈনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানানো শুরু করেন। জাহাজ চলাচলে এই নব্য ব্যবস্থা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

তবু ব্রিটিশ ভারতের সার্ভে সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র ঘাটলে পাওয়া যায়না রাধানাথ শিকদারের নাম। বারবার মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে তাঁকে. ১৮৫১ সালে সার্ভে সংক্রান্ত একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম 'Manual of Surveying'. বইটির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ রাধানাথের লেখা হলেও তাঁর মৃত্যুর পরে বইটির নতুন সংস্করণে সেই নামটি পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়। জাতপাত ধর্মের ঘেরাটোপে আটক থাকা তৎকালীন বাঙালীর গণ্ডি হেলায় অতিক্রম করে বিজ্ঞান ও গণিতের সেবায় ঊনবিংশ শতকের এই কৃতি ডিরোজিয়ান যে অসামান্য ছাপ ফেলেছিলেন, তাঁর সুফল আজও ভোগ করে চলেছে আধুনিক বিজ্ঞান ও জরিপশাস্ত্র। সোনা যায় ডিরোজিওর ভাবধারায় প্রবল আস্থাশীল এই মানুষটি সারাজীবন গোমাংস ভক্ষণ পর্যন্ত করতেন। ঠিক যেভাবে আর এক ডিরোজিয়ান রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়কে বন্ধুদের সাথে গোমাংস ভক্ষণের জন্য সেযুগে হিন্দু ধর্মচ্যুত হতে হয়েছিল। না, রাধানাথকে একঘরে করেনি বাঙালী, কিন্তু মনেও রাখেনি। অবসরের পরে বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রের সঙ্গে বাঙালী মেয়েদের পড়বার সুবিধার জন্য সরল গদ্য ভাষায় 'মাসিক পত্রিকা' প্রকাশ করলেও বাংলা সাহিত্যও কৌলিন্য দেয় নি তাঁকে। বরং 'মাসিক পত্রিকা' কে আমরা উল্লেখ করি কেবলমাত্র প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল'এর প্রথম প্রকাশের জন্য। শেষজীবনে খ্রীষ্টান হয়েছিলেন রাধানাথ। চন্দননগরে সাহেবদের কবরস্থানে একটি নির্জন সমাধি আর সামান্য একখানি রাস্তার নামকরণ ছাড়া আমরাই বা কী দিতে পেরেছি দুশো বছর আগের একজন আধুনিকমনস্ক উদার কর্মযোগী বিজ্ঞানসাধককে।

26 views0 comments

Recent Posts

See All

কালী কলকাত্তাওয়ালী

কলকাতা মানেই কালী। আর তাই কালী কলকাত্তাওয়ালী। প্রচলিত এই বাক্যবন্ধই বুঝিয়ে দেয় যে কলকাতা আর কালীর সম্পর্ক কতটা প্রাচীন। কিন্তু কোথায় সেই কলকাতার কালী। জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতায় কালীই পূজিতা। আর সেক্ষেত্রে য

bottom of page