top of page

মহাপঞ্চমীর আর লুপ্তপ্রায় ভাঙাচোরা শুকতোর খোঁজ

চৈতন্যচরিতামৃত'তে বলা হচ্ছে, রাঘব পন্ডিত মহাপ্রভুর জন্য নীলাচলে যে বিভিন্নরকম খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল শুকুতা বা সুকুতা,পরবর্তীতে যা শুক্তা অথবা শুক্তো নামে পরিচিতি পায়। কি ছিল এই শুকুতা? শুকুতা বলতে সেই সময় শুকনো পাতা বোঝানো হত যা ছিল বায়ুনাশক। তিতো পাটপাতাকেই ব্যবহার করে পাঁচমিশালি একটি পদ রান্না হত। সাথে থাকত নির্দিষ্ট কিছু মশলার ব্যবহার। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় পদ্মপুরাণ-এ বেহুলা লখিন্দরের বিয়ের ভোজনবিলাসে শুক্তোর উল্লেখ আছে। এমনকি রায়গুণাকার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলেও বাইশটি নিরামিষ পদের মধ্যে মহাসমারোহে বিরাজমান ছিল শুক্তো। এ তো গেল ইতিহাসের প্রাচীন উৎসকথা৷

এরপর আসে সাহিত্য, যেখানে ছোটগল্প উপন্যাসেও প্রায়শই উঠে এসেছে গ্রামবাংলার মানুষের জীবন আর খাদ্যাভ্যাস। এই যেমন ধরুন অজিত রায়ের লেখা 'দাসী' গল্পে লেখক বলছেন, "মোটকথা, দাসীই ছিল গৃহকর্ত্রী। তার কথাই সংসারে শেষ কথা ছিল। নিম্ন মাধ্যবিত্তের সংসার হলে কি হবে তাদের খাওয়া-দাওয়ার একটা মান ছিল । ঘরের সামনে উঠোনে ঝুলে থাকত কচিলাউ মাচার নিচে। পাশে লকলকে লাল শাক, সাদা শাক, পালং শাক, বাঁধা কপি ও ফুল কপি। আর সূর্য ওঠার আগেই দাসির শ্বশুর পাশের খাল থেকে জালে ধরত মোটা মোটা চামনি চিংড়ি, ফ্যাকশা মাছ, ইয়া বড় বড় বেলে মাছ ও ট্যাংরা মাছ। তা দিয়ে শুকতো আর আলুর ঝোল বানাত দাসী। দু-বাপ বেটা কবজি ডুবিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়ত কাজে "। সাহিত্য সময়ের দলিল। সাহিত্যকে সমসাময়িক সংবাদপত্র বললেও হয়ত অত্যুক্তি হয় না।


আজ মহাপঞ্চমী। আকাশে বাতাসে সুর,উৎসবের আমেজ। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে " মাগো,চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়, মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রী দূর্গা তাই দূর্গতি কাটিল না হায়"। প্রার্থনা ইচ্ছে-পূরণ নিয়েই বাঙালির এই মাত্র পাঁচটি দিন। বাংলা আর বাঙালির হেরিটেজ, সারা দেশ দুনিয়ায় একটা আলাদা স্থান করে নিয়েছে।


আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে বাঙালি ব্যস্ত বিশ্বচরাচরে। কর্মময় জীবনের ফাঁকে সামান্য ফুরসত পেলেই বাঙালি লেগে যায় রন্ধনশিল্পে। পালাপার্বণ হোক বা ঘরোয়া নিত্যদিনের পাকশালা, কুলীন স্থান অর্জন করেছে শুক্তো। সামান্য কিছু সবজী সাথে তিতোস্বাদযুক্ত যে কোনো একটি সবজি বা কোনো পাতার ব্যবহার করে একটি রান্না।

ঠাকুরবাড়ির দুধশুক্তো হোক অথবা শশাশুক্তো অথবা লাউডগাশুক্তো...শুক্তো হরেকরকম।

আজ ভাগ করে নেব লুপ্তপ্রায় আমিষ শুক্তোর কাঁটাচচ্চড়ি যা পূর্ববঙ্গে 'ভাঙাচোরা শুক্তো' নামেই অধিক পরিচিত। এ প্রচন্ড দাবদাহে এই লুপ্তপ্রায় পদটি শুধু শরীর নয়,ঠান্ডা করবে মনও।


এবার দেখে নেওয়া যাক রান্নার হালহকিকত।

কি কি লাগছে এই রান্নায় --


পেঁপে, ঝিঙে, বরবটি, আলু, উচ্ছে, রাঙা আলু,কাঁচকলা,লাউ, বেগুন, সজনেডাঁটা, ডালের বড়ি, আদাবাটা, কাতলা বা ভেটকি বা রুই মাছের মাথা ভাজা, মাঝারি সাইজের চিংড়ি ভাজা


শুক্তোর সিক্রেট মশলা -- গোবিন্দভোগ চাল, রাঁধুনি,মেথি,কালো সর্ষে, তেজপাতা।(সবকিছু শুকনো কাঠখোলায় ভেজে নিয়ে একদম মিহিগুঁড়ো করে নিতে হবে, জল ছাড়া )




রান্নাপদ্ধতি--

প্রথমেই সমস্ত রকম সব্জি লম্বা শেপে কেটে নিয়ে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। সম্পূর্ণ রান্নাটা হবে সর্ষের তেলে। কড়াইতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল দিয়ে মাছের মাথা এবং চিংড়ি ভেজে আলাদা রেখে দিতে হবে। ডালের বড়ি ভেজে নিতে হবে। এরপর উচ্ছে ভেজে সরিয়ে রেখে ওই তেলেই তেজপাতা একটা শুকনো লংকা হাফ চামচ রাঁধুনি এবং হাফ চামচ কালো সর্ষে ফোড়ন দিয়ে এক মিনিট সময় ধরে ভেজে গন্ধ বেরোতে শুরু করলেই সমস্ত সবজী দিয়ে নুন হলুদ দিয়ে ভাজা করতে হবে,অল্প নেড়ে অল্প ঢাকা দিয়ে এরকমভাবে। এভাবে অন্তত পনেরো মিনিট রান্না করার পর সবজিগুলো যখন নরম হয়ে আসবে তখন ভেজে রাখা মাছের মাথা, আগে থেকে ভেজে রাখা উচ্ছে, ভাজা বড়ি, আদাবাটা এক কাপ পরিমাণ দুধ এবং মিহিগুঁড়ো শুক্তো মশলা দিয়ে ভালভাবে মিক্স করে ক্রমাগত নেড়েচেড়ে যেতে হবে। এইসময় খুন্তি দিয়ে মাছের মাথা সমেত অন্যান্য উপাদানগুলি কেটে ভেঙে দিতে হবে, একটা সময় আসবে যখন সম্পূর্ণ রান্নাটা খুব সুন্দরভাবে সবকিছু মিলেমিশে একটা মণ্ড ধরণ তৈরি হবে। এই পর্যায়ে গ্যাস বন্ধ করে এক চামচ ঘি দিয়ে হালকা হাতে নেড়ে চাপাঢাকা দিয়ে রাখতে হবে অন্তত মিনিট পাঁচেক। তারপর ঢাকা খুলে পরিবেশন করুন বাংলার লুপ্তপ্রায় পদ ভাঙাচোরা শুকতো |


Recent Posts

See All

কালী কলকাত্তাওয়ালী

কলকাতা মানেই কালী। আর তাই কালী কলকাত্তাওয়ালী। প্রচলিত এই বাক্যবন্ধই বুঝিয়ে দেয় যে কলকাতা আর কালীর সম্পর্ক কতটা প্রাচীন। কিন্তু কোথায় সেই কলকাতার কালী। জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতায় কালীই পূজিতা। আর সেক্ষেত্রে য

bottom of page