দশরথ পুত্র রামচন্দ্র, মহাশক্তিশালী রাবণের সাথে যুদ্ধের আগে শুধুমাত্র শক্তি বুদ্ধি জয়ের আহ্বানে, সৌভাগ্য প্রার্থনার উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার বোধন করেন। আজ সেই দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠী তিথি। আজ দেবীর বোধনের দিন। প্রারম্ভিক এই ক্ষণে সমস্ত বাঙালি মেতে ওঠে এক অপরিমেয় আনন্দ উৎসবে।
বাংলার মানুষের জন্য এই পুজো বছরের সেরা সময়, ধনী গরীব নির্বিশেষে মানুষের ঢল দেখাই যেন এই পাঁচটি দিনের মহা প্রাপ্তি।
তবে সব আচার অনুষ্ঠানের সাথে যেমন জড়িয়ে থাকে ইতিহাস আর বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী দুর্গাষষ্ঠীও তার ব্যতিক্রম নয়। আর এই পৌরাণিক কাহিনীই বলে এই বোধনের নাম আদতে 'অকাল বোধন'। কেন অকাল বোধন? তা নিয়েও আছে কিছু কথা কিছু কাহিনী। সূর্যের উত্তরায়ন এবং দক্ষিণায়নের কথা তো সকলেরই জানা। উত্তরায়ন ছয় মাস দক্ষিণায়ন ছয় মাস। হিন্দু পুরাণ এবং হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরায়ণ সময়কালের ছয়মাস দেবদেবীর পূজাঅর্চনা রীতি এবং দক্ষিণায়ন সময়কাল দেবদেবীর নিদ্রাকাল। হিন্দুশাস্ত্র আরও বলে এই যে প্রত্যেক ছয়মাস তা আসলে একদিন গণনা করা হয়। যেমন দক্ষিণায়ন ছয় মাস অর্থে দেবতাদের রাত্রিকালীন যাপন। এ-সময় তাই তাদের নিদ্রা ভঙ্গ করে কোনো প্রকার উপাচার রীতি নিষিদ্ধ। অথচ এই নিদ্রাকালীন সময়েই যেহেতু দেবী দুর্গাকে জাগিয়ে নিদ্রাভঙ্গ করে তোলা হয়েছিল পুজোর জন্য তাই অগত্যা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তার বোধনের। রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার স্ত্রী সীতাকে মহাপরাক্রমশালী রাবণরাজের ঘেরাটোপ থেকে উদ্ধারের জন্য অসময়ে দেবী দুর্গার পুজো করতে উদ্যত হয়েছিলেন কারণ মা দূর্গা দুর্গতিনাশিনী। তাই এই বোধনের আরেক নাম অকাল বোধন।
বোধন কথাটির অর্থ হল জাগরণ। উত্থাপন। উজ্জাপণ। লোকাচার বলে দেবী দুর্গা তার সন্তানাদি সহ এই দিনেই মর্ত্যে আসেন। আর তার এই আগমন উপলক্ষে তার বোধন হয়। কল্কিপুরাণ বলে রামচন্দ্রকে রাবণবধে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা
এবার আসি ষষ্ঠীর ইতিহাসে।
ভাগবত অনুযায়ী -- “ষষ্ঠাংশা প্রকৃতের্যে চ সা চ ষষ্ঠী প্রকীর্তিতা / বালকানামধিষ্ঠাত্রী বিষ্ণুমায়া চ বালদা"
সাম্ভাব্য অর্থ অনুযায়ী ষষ্ঠাংশ থেকেই ষষ্ঠী নামকরণ উৎপত্তি।
"ওঁ গৌরাভাং দ্বিভুজাং ষষ্ঠীং নানালঙ্কার - ভূষিতাম |
সর্বলক্ষণ - সম্পনাং পিনোন্নতপয়োধরাম||
দিব্যাবস্ত্রপরিধানাং বামক্রোড়ে সপুত্রিকাম |
প্রসন্নবদনাং ধ্যায়ে জগৎধাত্রীং সুখপ্রাদাম ||"
ষষ্ঠীদেবীর এই ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী তিনি গৌরবর্ণা, দ্বিভুজা দুইবাহুযুক্তা নানাবিধ অলঙ্কারে সজ্জিতা সমস্ত সুলক্ষণ সম্পন্না স্তনযুগল পরিপূর্ণা।
দিব্যবসন পরিহিতা, বাঁদিকের কোলে সন্তান ধারণা, সদাহাস্যজ্বল, জগদ্ধাত্রী, সর্ব সুলক্ষণ সম্পন্না।ভরাট স্তনযুগল অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ ধারণকারী এবং বাম কোলে সন্তানসহ মূর্তি -- এ সবই মাতৃত্বের পরিচয় বহন করে। তাই মা ষষ্ঠীর পূজার্চনা সমস্ত সন্তানের মাকেই করতে দেখা যায়।
"জয় দেবী জগন্মাত জগতানন্দকারীনী |
প্রসীদ মম কল্যাণী নমস্তে ষষ্ঠী দেবীতে||"
-- মা ষষ্ঠীর প্রণাম মন্ত্র।
দেবী জগন্মাতা জগৎকে আনন্দদান করেন।কল্যাণী ,তোমায় প্রণাম ষষ্ঠীদেবী। লোকাচার রীতি অনুযায়ী বাংলা কালচারে অনেক গুলি ষষ্ঠী ব্রত পালন করতে দেখা যায়।শীতল ষষ্ঠী, সূতিকা ষষ্ঠী, মূলা ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী অশোক ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী , লুন্ঠন ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী, অরণ্যষষ্ঠী আরও নানাবিধ। মূলত সন্তানের দীর্ঘায়ু, সুস্থতা কামনা এবং ভালো কিছু প্রাপ্তির আশায় মায়েরা এই ব্রত করেন। ওই যে ঈশ্বরী-পাটনি কবিতায় কবি বলেছেন না "আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে"। মা ষষ্ঠীর পূজাও ঠিক এই মর্মার্থকেই প্রতিষ্ঠা করে।এই দেবীর বাহন হল বিড়াল। বিড়াল যেমন তার ছোট্ট ছানাদের অসম্ভব পরিচর্যায় সমস্ত বাধা থেকে সরিয়ে, দরকার হলে ঘাড় কামড়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে নয়ত জিভ দিয়ে চেটে শরীর পরিষ্কার করে অবধি যত্ন নেয় বড় করে তোলে, আমাদের মায়েরাও তার সন্তানকে ভাবে যত্ন নিয়ে লালন পালন করেন। তাই এই দেবীর বাহন বিড়াল । দেবীভাগবত পুরাণ মতে প্রিয়ব্রত নামক এক রাজাকে দিয়েই দেবী ষষ্ঠীর পূজা আরম্ভ হয়
মহাষষ্ঠীর দিন কল্পারম্ভ দিয়ে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। ওইদিন দেবীর বোধনের মাধ্যমে আহ্বান জানিয়ে এই মহোৎসব শুরু হয়। মূলত ষষ্ঠীর দিনটি বরাদ্দ আমন্ত্রণ কল্পারম্ভ অধিবাস আর বোধনের জন্য।
আজ এই মহাষষ্ঠীর দুপুরে এমন একটি পদ রান্না করব যে রান্নাটি আমার মাতৃকুলের দুর্গাপুজোয় ভোগ নিবেদন হয়ে আসছে অন্তত তিনশো বছর। আমার মামাবাড়ি প্রধানত রাধামাধব মন্দির সম্পন্ন। এরা প্রকৃত অর্থে শ্রীকৃষ্ণ উপাসক। কিন্তু কোনো আড়ম্বর ছাড়াই বহুকাল ধরে একই মন্দিরে পূজিত হয়ে আসছে মা দূর্গা। একটি পিতলের মূর্তির কীইই অপরূপ শোভা,না দেখলে বোঝা যায় না। ষষ্ঠীর দিন ভোগ হিসেবে "ছানার ডালনা" নিবেদন করা হয় মা'কে। আজ এই শুভ দিনে তাই এই রান্নাটিই করছি
পদের নাম -- ছানার ডালনা
উপকরণ -- জল ঝরানো ছানা, সামান্য ময়দা, সর্ষের তেল, গোটা গরমমশলা, গরমমশলা গুঁড়ো, ডুমো ডুমো করে কাটা আলু, ঘি, কাজু-কিশমিশ-পোস্ত- জিরে-ধনে- লঙ্কা একসাথে বাটা
পদ্ধতি -- এক লিটার দুধ নিয়ে ছানা কাটাতে হবে আগের দিন রাতে। ছানা কাটানোর জন্য পাতিলেবুর রস অথবা ভিনিগার এবং জলের মিশ্রণ অথবা ছানাকাটানোর পাউডার -- যেটা ইচ্ছে ব্যবহার করা যায়। ছানা কাটা হয়ে গেলে ছানাকে পরিস্কার জল দিয়ে একবার ধুয়ে নিয়ে একটা মসলিন কাপড়ে বেঁধে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে সারারাত। পরের দিন সকালে জল ঝরানো ছানাকে কাপড়ের মধ্যে পেতে একটা ভারী জিনিস দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতে হবে অন্তত তিন ঘন্টা। এতে ছানার কিউব তৈরির সময় সুবিধা হবে। তিন ঘন্টা পর মনের মতো টুকরো করে কেটে নিতে হবে ছানাটাকে।
এবার রান্নার পালা। ছানার টুকরোগুলো ডুবো তেলে মাঝারি আঁচে হালকা লাল করে ভেজে নিতে হবে। ছানার টুকরো যেমন সাইজের হবে আলুর টুকরোর মাপও কিন্তু একদম সেই সাইজ হতে হবে। ছানা ভাজা হয়ে গেলে ওই কড়াইতে আরও কিছুটা তেল দিয়ে আলুর টুকরোগুলোও লাল করে ভেজে নিতে হবে। এরপর কড়াইয়ে একটা শুকনো লংকা তেজপাতা দুটো এলাচ দারচিনি লবঙ্গ সামান্য সাদা জিরে ফোড়ন দিয়ে বেটে রাখা মশলা(বাটা মশলার তৈরি করতে হবে সাদাতিল পোস্ত কাজুবাদাম কিসমিস জিরে ধনে কাঁচালংকা আদা সবকিছু একসাথে বেটে,এই বাটার সময় নরমাল জল নয় ব্যবহার করতে হবে নারকেল ফাটানো জল)দিয়ে কষাতে হবে বেশ কিছুক্ষণ, এই সময়টা ধৈর্য দরকার খুব। কষানো হলে তেল ছাড়তে শুরু করলে ভেজে রাখা ছানার কিউব ভেজে রাখা আলু দিয়ে আবার বেশ কিছুক্ষণ রান্না করতে হবে,এইসময় দিয়ে দিতে হবে নারকেলের দুধ। সামান্য চিনি পরিমাণ মতো লবণ এবং দুটো চেরা কাঁচালংকা সামান্য গরমমশলা গুঁড়ো দিয়ে মিনিট তিনেক ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে, যাতে গরমমশলা আর কাঁচালংকার ফ্লেভার সমস্ত রান্নাটার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তিন মিনিট পর ঢাকা খুলে এক চামচ ঘি দিয়ে একবার নাড়িয়েচাড়িয়ে নিলেই তৈরি ছানার ডালনা।
মহাষষ্ঠীর এই রান্না আজ আমি করলাম ঠিক সেভাবে, যেভাবে আমার মাতৃকুলে আজকের দিনে রান্না করে মায়ের সামনে দেওয়া হয় সেভাবে।
আরও একবার ষষ্ঠীর শুভেচ্ছা সকলকে।