top of page

নবমীর বিদায়সুর, কলাপাতা পোড়া ইলিশ আর প্রাচীন বাংলার মৎসকাহন

সিদ্ধ গন্ধর্ব যক্ষ্যাদিরসুরৈরমরপি। সেবামনা সর্বদা ভূয়াত সিদ্ধিদা সিদ্ধিদায়িনী।


-- মন্ত্রপাঠে নাকি দুর্গতি কাটে। আজ নবমী। আকাশে বাতাসে মাটিতে ঝরা শিউলির মতো বিদায়ী গান। আগামীকাল দেবী ফিরে যাবেন। আবার অপেক্ষা। আজ তাই আনন্দ করে নেবার অন্তিম প্রহর। আজ দেবীর সিদ্ধিদাতা রূপের পুজো। আজ দেবীর পুজো করলে ভক্তি ভরে নিষ্ঠার সাথে সমস্ত আচার মানলে নাকি মহাবিদ্যার আটটি সিদ্ধি তিনি দান করেন। রোগ জ্বালা দারিদ্র,হতাশা থেকে মুক্তি পায় মানুষ। আজ মহাআরতী এবং বলিদান হয়। পুরাণ বলে আজকের তিথিতে দেবীকে তুষ্ট করতে পারলে নাকি মেলে সুখের চাবিকাঠি।


আজ বিদায়ের কথা বেশী না বলে বরং বিশেষ রান্না "কলাপাতাপোড়া ইলিশ " নিয়ে কথা হোক।



শক্তি চাটুজ্জে লিখেছিলেন--


"জেলেরা ইলিশ মারে মারুক

কাছে এসে দরদাম পারুক

এক হালি দুশো বিশ বলে

দরদাম তবুও তো চলে

আমরা স্টিমারে বসে দেখি

নৌকার মাছ ফুরালো কি?"


ইলিশ। একটি আবেগের নাম। একটি প্রজন্মের ধারাবাহিকতা এই রূপোলি শস্যের ওপর নির্ভরশীল। আসলে ইলিশ আমাদের রক্তে মিশে গেছে যুগ যুগান্তর ধরে। বাঙালির সংস্কৃতির ধারক বাহক মৎস্য প্রজাতির এই রানী, তাকে নিয়ে হাজার ছড়া গান কবিতা কাব্য গল্প উপন্যাস। সমকালকে কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে লেখক যতবার খাতাপেন নিয়ে বসেছেন ততবারই কোনো না কোনোভাবে উঠে এসেছে ইলিশকাহন। ইলিশের কাঁটা মুড়ো তেল থেকে শুরু করে আঁশ পর্যন্ত কিছুই বাদ দেবার নেই। এবার সকলে ভাবতে পারেন আঁশ কোন কাজে লাগে। হ্যাঁ ঠিক ইলিশের আঁশ তো খাওয়া যায় না তাহলে কি জন্য এই আঁশও এত যত্ন পায় সেটুকু জানতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে অবিভক্ত বাংলার লৌকিক কিছু রীতিতে। রীতি কেন বলছি, কারণ, অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় (বর্তমান বাংলাদেশ ) সরস্বতী পুজোর দিন "জোড় ইলিশ" নামের একটি আঞ্চলিক অনুষ্ঠান পালিত হয়,অনেকটা উৎসবের মতো করে। সেখানে বাড়ির কর্তাব্যক্তি যখন একসাথে দুটো অর্থাৎ জোড় ইলিশ নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন তখন গৃহিণীরা উলু শঙ্খধ্বনি সহযোগে তেল সিঁদুর ধান-দূর্বা দিয়ে বরণ করে নেন ওই ইলিশকে। এমনকি বাজারে জোড় ইলিশ না পেলে, অথবা আর্থিক টানাপোড়েন থাকলে একটি ইলিশের সাথে একটি বেগুন অথবা একটি লাউডগা দিয়ে জোড় তৈরি করবার প্রথাও দেখা যায়। প্রথমে আস্ত ইলিশ ধুয়ে আঁশ ছাড়িয়ে তারপর টুকরো করে কাটার পদ্ধতি চালু আছে। কাটার পর আঁশগুলো, তৎক্ষনাৎ বানানো একটি মাটির বাটির মধ্যে ভরে মুখ আটকে রান্নাঘরের পূর্ব কোণে রাখতে হয় সারাবছর। এভাবেই আঁশ অবধি হয়ে ওঠে অমূল্য রতন। কথিত আছে, রূপোলি ইলিশ সংসারের আর্থিক সমৃদ্ধির সূচক আর ঠিক এই কারণেই এই দিনের ইলিশ রান্নার পদ্ধতিও গতানুগতিক ধারার বাইরে। লংকা, তেল এবং হলুদ ছাড়া শুধুমাত্র সর্ষেবাটা সহযোগে আগুনের তাপে সেদ্ধ করাই হল এই রান্নার রীতি,সাথে প্রচলিত নিয়মে এইদিনের রান্না মাছের খাবার পর কাঁটা যদি বিড়ালের মুখে পড়ে তাকে নাকি ঘোর অমঙ্গলকর মনে করা হয়


আসলে ইলিশ নামের এই রূপোলি কন্যা ছড়িয়ে আছে গ্রাম শহর নির্বিশেষে সমাজের সকল গোত্রের মানুষের মধ্যে। ভাঁপা হোক বা ঝাল, টক হোক বা তেল করলা, বেগুনতেল হোক বা কচুরশাক... ইলিশ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই বাংলায়। এতটা জনপ্রিয়তার জন্যই হয়ত কবির কবিতায় বা গানে বা উপন্যাসে জায়গা করে নিয়েছে এই মাছ। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনেও ইলিশ চমৎকারী। বিজ্ঞাপনটি হল," মাছের রাজা ইলিশ, বাতির রাজা ফিলিপস"। ইলিশ নিয়ে ছড়ার শেষ নেই এই বঙ্গে। হাজার কাহিনীতে ভরা ইলিশি যাত্রাপথ। লোকাচার অনুযায়ী দুর্গাপূজার দশমীর দিন ইলিশের ডিম এবং পুঁটিমাছ খাওয়া গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে একটি অতি প্রচলিত প্রথা। সেই সময় ইলিশের ডিমের আকাল লেগে যাবার ভয়ে রীতিরেওয়াজ মানা মানুষজন দশমীর আগের থেকেই এনে রোদে শুকিয়ে বা আজকাল ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করেন এই মাছের ডিম। তাঁদের ধারণা ইলিশের ডিমের মতো পয়সার বৃষ্টি হবে তাদের সংসারে। গ্রামবাংলার বউঝিরা এইসময় গান ধরেন,

" ইলিশ মাছ কাটে বউ, ধার নাই বটি দিয়া

ইলিশ মাছ রান্দে বউ,কচু বেগুন দিয়া "


মাঝি জেলেদের মধ্যে আবার আরেক রীতি। তারা মাছ ধরতে যাবার আগে ইলিশের সামনে নৌকায় বসে ধূপ ধূনা দিয়ে পূজা করেন। ইলিশ সংগ্রহ করে ফিরে আসার পর একটি ইলিশ কেটে নৌকার অগ্রভাগে রেখে বলি চড়ানোও তাদের নিয়ম। কুসংস্কার হোক বা মানসিক বিশ্বাস, শান্তির পথে কোনো কিছুই যে বাধা হতে পারে না তার প্রমাণ ইলিশ।

হাজার নিয়ম। হাজারো সংস্কার।

দিনটি ছিল ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল।পয়লা বৈশাখ। বাংলা আর বাঙালির নববর্ষ। সবটুকু শুভ দিয়ে শুরু করার এই দিন। তো সেদিন এক বেকার যুবক রোজগারের আশায় ঢাকার রাস্তায় পান্তাভাত এবং ইলিশ মাছের হরেক পদ নিয়ে বিক্রি করতে বসেন। উৎসবের এই দিনে ঘুরতে বেরোনো মানুষরা তাঁর থেকে সেই পান্তা, ইলিশ মাছ কিনে খান। ধনলক্ষ্মীর আশির্বাদে, অসীম কৃপায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেকার যুবক পয়সার মুখ দেখেন। সেই থেকেই , ঢাকার মানুষের মধ্যে এটি প্রচলিত যে, পয়লা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খেলে, গোটা বছর আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটবে।


হায় রে লোকাচার। হায় রে সংস্কৃতি। একে সংস্কার বলব নাকি কু-সংস্কার? বাঙালি বোকা না সরল?নাহ, এসব নিয়ে তর্কে যাব না। আজ হোক মরসুমের ইলিশ আয়োজন।


আজ লুপ্তপ্রায় এক ইলিশি পদ রান্না করব।


নাম --

কলাপাতা পোড়া ইলিশ


উপকরণ --

ইলিশ মাছ টুকরো করে কাটা

কালো সর্ষে কাঁচালংকা এবং নারকেল একত্রে মিহি বাটা

কলাপাতা (আগুনের তাপে খুব হালকা সেঁকে নেওয়া )

সর্ষের তেল

নুন

হলুদ

গোটা কাঁচালংকা (সাজানো গোছানোর জন্য )



প্রণালী --

ইলিশ মাছের টুকরোগুলো ভালো করে ধুয়ে নুন এবং হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে অন্তত কুড়ি মিনিট। অন্যদিকে নারকেলকোরা, পরিমাণ মতো কালো সর্ষে, কাঁচালংকা একসাথে বেটে নিতে হবে মিহি করে। যত মিহি হবে এই বাটা বা মিশ্রণ ততই সুস্বাদু হবে রান্না।কলাপাতা টুকরো করে কেটে ধুয়ে শুকনো করে নিয়ে আগুনের তাপে খুব হালকা সেঁকে নিতে হবে যাতে পার্সেল তৈরির সময় পাতা গুটিয়ে না যায়। একেক টুকরো কলাপাতা নিয়ে তার ওপর একটা মাছের পিস রেখে তাকে ঘন মিশ্রণ দিয়ে মাখিয়ে ওপর থেকে একটা চেরা কাঁচালংকা এবং সামান্য সর্ষের তেল দিয়ে চারদিক থেকে মুড়িয়ে ভাঁজ করে একটা পার্সেল প্যাকেটের মতো তৈরি করে নিয়ে সুতো দিয়ে খুব ভালভাবে পেঁচিয়ে গিঁট দিলেই তৈরী পার্সেল। সম্পূর্ণ রেডি করে নিয়ে একটা ফ্ল্যাট ফ্রাইংপ্যানে অল্প করে তেল ব্রাশ করে নিয়ে গ্যাস ধরিয়ে পার্সেলগুলো বসিয়ে দিতে হবে পরপর সাজিয়ে। তারপর চাপাঢাকা। কিছুক্ষণ পর উলটে দিয়ে অন্যদিক হতে দিতে হবে। আবার কিছুক্ষণ পর আরেকবার উল্টে দিয়ে, এভাবে অন্তত পঁচিশ মিনিট রান্না করলেই প্রায় তৈরি রান্না। একদম শেষে প্যান থেকে নামিয়ে একটা লোহার ছাঁকনি গ্যাসের আগুনের ওপর বসিয়ে খুব ভালো করে তেতে উঠলে গ্যাসের তাপমাত্রা কমিয়ে তাতে এক এক করে পার্সেলগুলো দিয়ে হালকা আঁচে পোড়া পোড়া করে নিলেই তৈরি কলাপাতা পোড়া ইলিশ।


রবিবারের দুপুর হোক অথবা বিশেষ অনুষ্ঠানের মেনু,তাক লাগিয়ে সকলকে চমকে দিতে পারে পূর্ববঙ্গীয় এই পদ,তবে হ্যাঁ সাথে অবশ্যই যেন থাকে জুঁইফুলের মতো গরম ধোঁয়া ওঠা একটু ভাত আর একটা কাঁচালংকা


নবমী সকলের জন্য বয়ে আনুক আনন্দগান, প্রাণের স্পন্দন, খুশিভরা চোখ।


Recent Posts

See All

কালী কলকাত্তাওয়ালী

কলকাতা মানেই কালী। আর তাই কালী কলকাত্তাওয়ালী। প্রচলিত এই বাক্যবন্ধই বুঝিয়ে দেয় যে কলকাতা আর কালীর সম্পর্ক কতটা প্রাচীন। কিন্তু কোথায় সেই কলকাতার কালী। জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতায় কালীই পূজিতা। আর সেক্ষেত্রে য

bottom of page